মেকুর (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৩)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১১:৫১:০৪ সকাল
সময় সময়ের ভিতর থেকে প্রচন্ড এক দুঃসময় বয়ে এনেছে আমার জন্য।
আমি দেহমনে তীব্র এক যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার হৃদয়ের ক্ষত যা প্রতিটি ক্ষণে কেবলি আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে... প্রলম্বিত এক যাতনার ব্যবচ্ছেদে আমি বোবা অনুভূতিতে বিলীন হচ্ছি।
আমার মেয়ের কথা মনে পড়ে... বউয়ের মুখটা চোখে ভাসে। চলার পথে ছোট মেয়ের হাত ধরে কোনো গৃহবধুর হাসিমুখ আমাকে পাগল করে দেয়। ওদের নিরন্তর বয়ে চলা এই সুখ আমার সহ্য হয় না। ইচ্ছে করে এক লহমায় ওদের হাসি হাসি মুখগুলো বেদনায় ভারাক্রান্ত করে দেই। কোথা থেকে এক নরপশু আমার ভিতরে জেগে উঠে সবকিছু লন্ড ভন্ড করে দিয়ে যেতে চায়।
তারপরও আমি বেঁচে থাকি। তিনবেলা খাবারের খোঁজে চিন্তা-ফিকির করি। পকেটে কোনো টাকাই থাকেনা। তারপরও দিব্যি কিভাবে যেন বেশ চলছি। আসলে মানুষের উপরে বিগত বছরগুলোতে নির্ভর করে চলতে চলতে, এক অভ্যাসগত চারিত্রিক গুনাবলীতে আচ্ছন্ন এই আমি নিজেকে অন্যের ভিতরেই কেবলি খুঁজে চলেছিলাম।
দিনের বেলা বঙ্গবন্ধু হলের পরিচিত রুমটিতে অলস সময় কাটাই। কিংবা ছাদের উপরে নির্জনে একা একা থাকি। এই সময়টিতেই অনেক এলোমেলো ভাবনা আমার মনে দোলা দিয়ে যেতে থাকে।
এই যে আমার বর্নাঢ্য মানবজীবন (আমি দ্বিধাগ্রস্ত আমার এই জীবনকে মানব জীবন বলা চলে কিনা? তাও আবার বর্নাঢ্য!!), একে আমি কিভাবে দেখছি? নিজেকেই প্রশ্ন করি। আর উত্তর খুঁজে বেড়াই নিজের মনে মনে।
জীবন আমার কাছে ‘এয়াজ বদলের’ মত মনে হয়। শব্দটা ‘ওয়াজ বদল’ ও হতে পারে। একের জমি অন্য একজনের নামে হস্তান্তর বা বদল করাতে এটা বুঝানো হয়। যেমন আমাদের সমাজের কাঠামোটাকে যদি দেখি, এখানে বিভিন্ন প্রকার পেশাজীবি এবং বিভিন্ন গোত্রতে বসবাস করছে।
একদিন হুট করে জীবনটাকে বদল করে দেখলে কেমন হয়?
তবে জীবন বদল করাটা খুব সহজ নয়। এর জন্য বিশেষ কিছু দরকার হয় না, শুধু লাইফ ইভেন্ট গুলো চেইঞ্জ করলেই হয়।
জীবন বদলের ভাবনায় তাড়িত হয়ে আমি চিন্তা করলাম, আমি যদি গাড়ীর হেল্পার হতাম কেমন হতো ? যেই ভাবা সেই কাজ। পরিচিত একজনকে ধরে বললাম, ‘ভাই বিপদে আছি, আপনার ষ্ট্যান্ডের একটা গাড়ীর হেল্পারের কাজ যোগাড় করে দিন না।‘
বেচারা আকাশ থেকে পড়লেও আমার চাপাচাপিতে রাজি হয়ে গেল। টঙ্গী থেকে তখন গাজীপুর গামী রাইডার চলতো। হয়ে গেলাম হেল্পার। প্রথম দিন ভাড়া নেওয়াটা একটু কষ্টকর হলেও পরে ঠিক হয়ে গেল। একসপ্তাহে পরিবর্তন হয়ে গেল। 'আমার বন্ধু, আমার লাইফ ষ্টাইল, রাস্তার পাশে বাথরুম সারা থেকে শুরু করে বন্ধুদের সাথে গাঁজার মত ভয়ঙ্কর জিনিসে টান দেওয়া, বালতিতে করে পানি এনে গাড়ি পরিষ্কার করা, কিভাবে টাকা মারতে হয়, এ সব কিছু শিখলাম।
সব শেষে যা পেলাম তা হল, এই পেশায় ভালমানুষীর কোন মূল্য নেই।
স্বাধ নিলাম অনেক কিছুর। রাতের অপ্সরীরা কি করে, কারা কোন ধান্ধায় ঘুরে এগুলো জানলাম। তবে এখানে শিখলাম আরেক জিনিস।
বেশির ভাগ হেল্পাররাই ড্রাইভারের গোলাম।
বেশির ভাগ হেল্পাররা জানে না আগামীকাল বলে কিছু আছে।
এ লাইনে টাকা ধার চাইলে পাওয়া যায়।
একদিন বসা থাকলেও খাবার মিলে।
এতো গেলো একজন হেল্পারের জীবনে এসে নিজেকে চেনা।
কিন্তু আমি... আমার অবস্থানে এসে নিজেকে দেখতে চাইলাম।
সবার মাঝে একটা মিল আছে আর সেটা হলো সবাই তাদের পিতামাতাকে ভীষণ ভালবাসে, পারলে কলিজা বিক্রি করে দেয় ওদের জন্য।
এরপর এক এক করে হয়েছি খেয়া ঘাটের মাঝি, ভবঘুরে, জেলখানার কয়েদী পর্যন্ত (আমাকে ক্যাম্পাস থেকে ৫৪ ধারায় একবার চালান করে দিয়েছিল)।
জীবনটা সব জায়গাতেই রং হীন পেলাম।
তবে ভবঘুরে বেকার জীবনটাই হচ্ছে এর মধ্যে সবচেয়ে কষ্টের। সব দিক থেকে এরা ভিক্ষুকদের চেয়েও নীচু লেভেলের।
একবার ভাবনা হলো মাঝ রাতে একা নৌকায় মদ খেতে কেমন লাগবে? খুব রিস্কি ব্যাপার। নিজে নৌকা বাইতে জানতাম। তো শীতলক্ষা নদীর মাঝখানে গিয়ে রাতভর চিৎ হয়ে শুয়ে চাঁদ দেখলাম।
ভয়ঙ্কর ভাবনা ছিল সেটা। তবে ওভাবেও জীবনকে বর্ণহীন পেলাম।
আর একদিন ভাবনা হল, রাতের বেলায় গরুর গাড়িতে কেউ বাড়ি ফিরবে-এই ভাবনাটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। সেটাও পুরোন করেছি গাজীপুর মাওনাতে।
খালি পায়ে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ানো বা লুঙ্গী পড়ে ভার্সিটির অনুষ্ঠানে যোগদানের মত ভয়ঙ্কর ব্যাপারটাও করে ফেলেছি একবার।
একবার এক বিচ্ছুকে নিয়ে গেলাম বাগেরহাট। উদ্দ্যেশ্য ছিল দুজনে মিলে এলাকায় ফেরী করবো লেইস ফিতা। পথে নদী পড়ল... নদী পার হলাম, মাঝি টাকা চাইলো, বললাম আমরা থানার লোক।ব্যাটা ভাবলো আমরা পুলিশ, দ্বিতীয়বার আর চাইলো না
সাথের বিচ্ছু বলল, ‘আপনি মিথ্যা বললেন কেন?
আমি বললাম মিথ্যা বললাম কই, আমি বা তুমি কোন না কোন থানার লোকই তো, তাই না, সেটাই তো বললাম।
মাঝে মাঝে আমার মাথায় শয়তানে টোকা দেয়, তখন অনেক মজার কাজ করে ফেলি।
একবার ফার্ম গেইট গেলাম বাসে অলস ঘুরতে ঘুরতে।
অনেক টাইম হাতে, ভাবলাম ফুটপাত থেকে কয়টা টি-শার্ট কিনি, দেখি এরা কিভাবে কি করে। পরে দুইটা টি শার্ট কিনলাম ৩০ টাকায়। আর কথায় কথায় সেই বিক্রেতা আমাকে দুপুরের খাবার খাওয়ালো এবং বাসায় আসার জন্য গাড়ী ভাড়াটাও দিয়ে দিল।
একটা ঠান্ডা প্রতিশোধের কথা মনে পড়ল। আমার এক জুনিয়র ফ্রেন্ড সদ্য প্রেমে ছ্যাকা খাইছে এক মেয়ের কাছ থেকে । অনেক টাকা ফাও হারাইছে। সে কেইসটা আমাকে ডিল করতে দিল, ব্যাস হয়ে গেল কাজ শুরু।
প্রথমে বন্ধুত্ব করলাম। তারপর মাঝে মাঝে সময় দেয়া।এরপর ফাইনাল রাউন্ড। রাতের বেলা ঘুম ভাঙ্গলে বিশেষ করে রাত ২ টার দিকে ফোন দিতাম। কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে দিতাম। তারপর ২ মিনিট ফাও আলাপ সেরে ফোন রেখে দিতাম।
একসময় দেখলাম তার রূপ যৌবনে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। তিন মাস এভাবে চলার পর সে একদিন আমাকে ডেকে ক্ষমা চাইল। আমি এবার তার হাতটা ঐ জুনিয়র বন্ধুর হাতে বেঁধে দিয়ে ভাগলপুর চলে এলাম।
এবার আমাকে খুব খারাপ একজন মানুষ লাগছে, তাই না ? আসলেই আমি নিজে প্রচন্ড রকম খারাপ একজন ব্যাক্তি। না হলে আমার সকল প্রিয়জনেরা এভাবে আমাকে ছেড়ে চলে যায়?
আমি আমার জীবনটাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছি...
একটা আলোয় ভরা অন্যটা অন্ধকার।
কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি, এই যে বিভিন্ন চরিত্রে আমি নিজে কে দেখলাম। এ সব কিছু মিলিয়ে আমি আসলে কে?
আসলে কে আমি?
নিজের মনই আমাকে উত্তর দিয়ে দিলো।
আমি আসলে সময়ের স্ফটিক।
আমি একধারে বিচ্ছিন্ন একটা সময় , মানব জনম খুব সাধন করে হয়। এ জন্ম কোনভাবে বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। অন্যকে সম্মান করার জন্য, অন্যকে ভালবাসার জন্য এ জনম। পৃথিবীর রহস্য নয়, নিজের রহস্য জানার জন্য নিজেকেই সাধন করে যেতে হবে।
আর এটা করার অন্যতম শর্ত হলো, সবার আগে মানুষ সত্য বিষয়টি মনে আনতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কাছে পৃথিবী নিরাপদ নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি মানুষ নই। আমি যেদিন ১০০% মানুষ হবো, সেদিন পৃথিবী আমার গোলামী করবে, আমি তার বাদশাহ হবো।
আমি কি বাদশাহ হতে পেরেছি? কিংবা মানুষ?
কিভাবে বুঝব আমি মানুষ হতে যাচ্ছি ? আমি আংশিক হয়েছিলাম- এখন আবার পতন হচ্ছে।
তবে এটাকে রোধ করার পথও রয়েছে। আর তা বেশ কঠিন কাজ, যাকে বলে নির্বান লাভ করা। যুগে যুগে সকল মহাসাধকগণ এটা করতে পেরেছিলেন। আমি এ পথে কাউকে ডাকি না। একজন মেকুর কখনো কাউকে ডাকবে না। মেকুরকে দেখে অন্যরা স্বেচ্ছায় চলে আসবে। কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডাকলে তাতে বর্তমান সমাজের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। মানুষ হিসেবে যা যা করার তা আগে যদি শেষ করতে পারি- দেখা যাবে নিজেকে সে একাই টেনে নিয়ে যাবে।
আমি যদি ধর্মের দিকে তাকাই, আমি হয়ত অনেক কিছুই পালন করি না। তবে ধর্ম পালন করেও অনেকে ধর্মের জন্য কিছুই করতে পারে না। সেটাও কি ঠিক?
... ...
বঙ্গবন্ধু হলের ছাদের উপরে বসে বসে এইসব এলোমেলো ভাবনায় বিলীন হচ্ছিলাম। একটা ভূবন চিলের চীৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, চিলটি ক্রমাগত নির্দিষ্ট কিছু যায়গা জুড়ে পাক খাচ্ছে। হয়তো কোনো শিকারের সন্ধান পেয়েছে। এখন আক্রমনের পায়তাড়া করছে। আকাশের নীলের ভিতরে সৌন্দর্যের চেয়ে আমি বেদনাকে অনুভব করলাম বেশী! নিজেকে ঐ চিলের শিকার মনে হল। আমার হৃদয়ের বেদনাগুলো আমার মাথার উপরের নিঃসীম নভোতে পুঞ্জীভূত মেঘ হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। আর আমি এক শিকার হয়ে মুহুর্তে শেষ হয়ে যাবার জন্য আনন্দে চোখ বন্ধ করলাম।
আহ! যদি এই মুহুর্তেই শেষ হয়ে যেতে পারতাম!!
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১১০৭ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর মন্তব্যের জন্য শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য অনেক শুভেচ্ছা।
এরপরের পর্বগুলো একটু দেরীতে লিখতে চাচ্ছি।
এর মাঝে হয়তো অন্য কিছু চলে আসবে।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
এবারে আপনাকে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে ভাই। বাকী পর্বগুলো ধীরে ধীরে পোষ্ট করতে চাচ্ছি।
শুভেচ্ছা রইলো।
ধন্যবাদ নান্দনিক এবং অনুপমেয় মন্তব্যের দ্বারা আমাকে অনুপ্রেরণা দেবার জন্য।
শুভেচ্ছা রইলো। ভালো রাখুক আল্লাহপাক আপনাকে।
ভাই এটা কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের হল? ঢাবি?
গল্প ভালো হয়েছে।
না এটি জাবি (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)।
শুভেচ্ছা রইলো।
ভালো লাগা রেখে যাবার জন্য অনেক শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
তিনটে পর্বই পড়লাম..
হুমায়ূন আহমদের শূণ্যতা পূরণের একটা এসাইনমেন্ট নিতে পারবেন মনে হয়-
আশা করা কি অন্যায় হবে???
ধন্যবাদ পর্ব তিনটি পড়বার জন্য।
মনে হয় না স্যারের যায়গা অন্য কেউ পূরণ করতে পারবে। কারণ আসলে কেউ কারো মত হয় না।
আপনার অনুভূতির প্রতি সম্পুর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি,তার লেখা এতোটা পড়েছি যে, ইচ্ছে করলে ওনার কপি করতে চাইলে অবচেতন মনে কেন জানি লেখার ধরণ স্যারের মত চলে আসতে চায়। অনেক কষ্টে সেখান থেকে ফিরে আসি।
শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন